।।কালের কন্ঠ।।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ আর বেঁচে নেই। ৯০ বছর বয়সে তিনি মারা গিয়েছেন।
এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত এই রাজনীতিবিদের বর্ণময় অধ্যায়।
শেষ ক’টা দিন
‘‘প্রতিদিন ডাকলে চোখে মেলে তাকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আজ তা করেননি,’’ মৃত্যুর আগের দিন ভাই জিএম কাদের বলছিলেন। আর চোখ মেলা হয়নি। ১৪ জুলাই সকাল পৌনে ৮টায় এরশাদের মৃত্যুর ঘোষণা দেন হাসপাতালের ডাক্তাররা। গত ২৭ জুন সকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে শেষবারের মতো তাঁকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। তাঁর রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বল্পতা ছিল। ফুসফুস সংক্রমিত ছিল ও ভুগছিলেন কিডনির জটিলতায়। তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল।
অন্যতম আলোচিত চরিত্র
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত চরিত্র হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। সেনা কর্মকর্তা থেকে স্বৈরশাসক, সেখান থেকে গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতিক – বারবারই উলটে পালটে দেখেছেন নিজেকে, সবাইকে দেখিয়েছেন। আর জন্ম দিয়েছেন একের পর এক আলোচনা-সমালোচনার।
কোচবিহারে জন্ম
অবিভক্ত ভারতের কোচবিহার জেলায় জন্ম এরশাদের। পরিবার রংপুরে চলে এলে সেখানেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন তিনি। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে ১৯৫২-তে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।
সেনাবাহিনীতে এরশাদ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পান এরশাদ। ১৯৭১-৭২ সালে ছিলেন সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে ফেরেন বাংলাদেশে। ১৯৭৫ সালে মেজর জেনারেল হয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে হন সেনাপ্রধান। পরের বছর পদোন্নতি পান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে।
অবৈধ ক্ষমতা দখল ও স্বৈরশাসন
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয় ১৯৮১ সালের ৩০ মে। প্রথমে ভারপ্রাপ্ত ও পরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। তাঁর সরকারকে উৎখাত করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন ১৯৮৩-র ডিসেম্বর পর্যন্ত। এরপর রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে রাষ্ট্রপতি হন।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ও এরশাদের পতন
১৯৮৬ সালে এরশাদ জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচন দেন। আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তবে বিএনপি তা বয়কট করে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এরশাদ। তবে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে ৭ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে এই সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। ১৯৮৮ সালের নির্বাচন সব বিরোধী দল বয়কট করে। সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন এরশাদ।
নব্বই পরবর্তী এরশাদের রাজনীতি
১৯৯১ সালে কারাবন্দি হন এরশাদ। কিন্তু সেখান থেকেই অংশ নেন নির্বাচনে। অন্তরীণ অবস্থাতেই ১৯৯১ ও ১৯৯৬ নির্বাচনে পাঁচটি আসনে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। ছয় বছর জেলে থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন। তবে আদালতের রায়ে দণ্ডিত হওয়ার কারণে সংসদে তাঁর আসন বাতিল হয়।
এরশাদের জাতীয় পার্টির ভাঙ্গা-গড়া
দলীয় কোন্দলে এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি পরবর্তীতে অন্তত তিন ভাগে ভাগ হয়। মূল ধারার চেয়ারম্যান থাকেন এরশাদ। স্ত্রী রওশন এরশাদ, ভাই জিএম কাদের এ ধারায় তাঁর সঙ্গে থাকেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অংশ হয়েও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তাঁর দল প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং রওশন এরশাদ প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করেন এরশাদ।
রাজনীতির আকর্ষণীয় চরিত্র
এরশাদকে নিয়ে পরবর্তীতে নানা সময়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মাঝে টানা হ্যাঁচড়া চলেছে। তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সমালোচনা ছিল, তিনি দলীয় ও রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করতেন। তাঁর বক্তব্য প্রায়ই সমালোচনার জন্ম দিত। তারপরও নিজ এলাকা রংপুরে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে রাজনীতির বর্ণময় এক চরিত্র ছিলেন এরশাদ।
ব্যক্তিগত জীবন
এরশাদের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল বৈচিত্র্যময়। তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ। আরেক স্ত্রী বিদিশার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয় ২০০৫ সালে। দুই স্ত্রীর ঘরে তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে। তারা হলেন- রাহগির আল মাহি এরশাদ, এরিক, আরমান এরশাদ ও জেবিন।
মন্তব্য করুন