মোঃ জামাল উদ্দিন : ডাক্তার শংকর বড়ুয়া আমার দেখা মেধাবী মানুষদের একজন। ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন তুখোড় মেধাবী। সেটি দেখার সুযোগ হয়েছিল মূলতঃ একটি কারনে। তিনি প্রাইমারী শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন আমার বাড়ি সংলগ্ন একসময়কার উখিয়ার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তুতুরবিল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। আমরা যবে প্রাইমারী স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিলাম, সেসময় তাঁর প্রায় শেষের দিকে। তিনি প্রাইমারী শিক্ষাজীবনের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সব ক্লাসের-ই ফার্স্টবয় ছিলেন। আমার জানামতে, তিনিই একমাত্র ছাত্র, যিনি সেসময় তুতুরবিল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন। এরপর আজ অবদি অন্যকোন ছাত্র পেয়েছিল কিনা আমার জানা নেই।
এখনকার মত সেসময় স্কুল ব্যাগের তেমন প্রচলন ছিলনা। আমার এখনো মনে আছে, ডাক্তার শংকর দা তাঁর ছোট ভাই সমীরণ দা’সহ প্রায় কয়েক কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে অাসতেন। যখন থেকে ওনাকে দেখছি, অতি সাধারন চালচলনের একজন মানুষ মনে হয়েছে। এখনো তা-ই। সাফল্যের একেবারে চুড়ায় থেকেও এমন সাধারন জীবনযাপন আর নিরহংকারী মানুষ খুব কম-ই দেখা যায়। এখানেই ডাক্তার শংকর দা মানুষ হিসেবে অন্যদের থেকে অালাদা।
ডাক্তার শংকর বড়ুয়ার ভিত্তি গড়ে দেওয়ার অন্যতম কারিগর সেসময়ের উখিয়া উপজেলার শ্রেষ্ঠ ও অাদর্শ শিক্ষকদের একজন, তুতুরবিল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক অামাদের শিক্ষাগুরু জনাব বকতিয়ার অাহমদ স্যারের কাছে ওনার মেধার গল্প শুনতাম। অামরা যারা পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সিলেক্টেড হয়েছিলাম, তাদের সবাইকে প্রধান শিক্ষক বকতিয়ার স্যার তাঁর অফিস কক্ষেই আলাদা টুল-টেবিল বসিয়ে কোচিং করাতেন। পড়ানোর সময় কোন কারনে স্যার আমাদের উপর রেগে গেলে অফিসের দেওয়ালে টানানো বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকাটি দেখিয়ে বলতেন, “বৃত্তি পেতে হলে শংকরের মত হও।” স্যার কেন একথা বলতেন, তা বেশ ক’বছর থেকেই বুঝে অাসছি।
বেশ ক’বছর আগের কথা। ডাক্তার শংকর দা’র তখন খ্যাতির মুকুট ছুঁইছুঁই অবস্থা। নিজ এলাকার মানুষের সেবার মানসে কোর্টবাজারে সপ্তাহে দু’একদিন রোগী দেখতেন। একদিন বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ওনার চেম্বারে। ভিতরে ঢুকতেই বাবাকে দেখে বললেন, “মুরুব্বীর বাড়ি তুতুরবিল না?” হ্যাঁ বলতেই বাবার সম্পর্কে অনেক কথা বলতে লাগলেন। বাবাকে চিনেন, কতবার যে দেখেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সবচেয়ে স্মরণ রাখার মত ছিল, সবকিছুর পর ফি দিতে চাইলে টাকাটা বাবার হাতে ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, “টাকাটা নিয়ে অাপনি ঔষুধ কিনবেন আর চা-নাস্তা খাবেন!” এরপর থেকে বাবার শরীর সামান্যতম খারাপ লাগলেও শংকর দা’কে দেখাতে বলতেন। সেদিন-ই বুঝেছিলাম, তুতুরবিল নামটির প্রতি ডাক্তার শংকর দা’র এখনো ভীষণ দুর্বলতা কাজ করে।
আরেকবার একাডেমিক সার্টিফিকেট সত্যায়িত করার জন্য কোর্টবাজারস্থ তাঁর চেম্বারে গিয়েছিলাম। বাইরে রোগীর প্রচন্ড ভীড়। চেম্বারের বাইরে থাকা সহকারীর মারফত খবর পাঠিয়েছিলাম এই বলে যে, সার্টিফিকেট সত্যায়িত করার জন্য তুতুরবিল থেকে একজন লোক অাসছে। এবারও একইভাবে একই রকম সমাদর। প্রচন্ড ব্যস্ততার মাঝেও হাসিমুখে সেদিন আমার সার্টিফিকেটগুলো সত্যায়িত করার ফাঁকেফাঁকে তুতুরবিল সম্পর্কে টুকটাক অনেক কিছুই জানতে চেয়েছিলেন। অথচ, আমাকে দেওয়া সময়টাতে তিনি অনায়াসে দুয়েকজন রোগী দেখে ইনকামের পরিমানটা ভারী করতে পারতেন। তাই বলছি, এই মানুষটার মাঝে বিরক্তিবোধ এবং লোভ জিনিসটা দেখিনি। এমন মানুষ সচরাচর দেখা যায়না। তাই শ্রদ্ধা এবং ভালবাসাটাও ওনার প্রাপ্য।
সময়ের ব্যবধানে প্রত্যাশিতভাবে শংকর দা এখন অনেক বড় মাপের ডাক্তার। যশ, খ্যাতি অার অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক। একাধারে মেডিসিন, ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞ। প্রচন্ড ব্যস্ততায় সময় কাটান নিঃসন্দেহে। তথাপিও, সময়সুযোগ করে প্রত্যেক মাসে নিজ এলাকায় এসে রোগী দেখেন। কখনো ফি নেন, অাবার কখনো নেননা। টাকার জন্য কখনোই কোন রোগীকে প্রেসার ক্রিয়েট করেছেন বলে শুনিনি। গরীব-অসহায় রোগীদের বিনা ফি’তে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন হাসিমুখে। এমন মানবিক এবং সামাজিক দায়িত্ববোধসম্পন্ন ডাক্তার অাজকাল খুব কম-ই দেখা যায়।
ডাক্তার শংকর দা আমাদের প্রাপ্তীর এক সুবিশাল ও সমুজ্জ্বল নমুনা। নিশ্চিতভাবে, আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার। অামাদের প্রত্যাশা, দেশের প্রতিটি এলাকায় এমন ডাক্তার তৈরী হউক, যারা কেবল টাকার জন্য নয়, মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেবেন ডাক্তার হিসেবে নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে।
শুভ জন্মদিন প্রিয় ডাক্তার শংকর বড়ুয়া। আপনি দীর্ঘজীবী হউন মানুষের জন্য।
ব্যাংক এশিয়া মাতারবাড়ি শাখার ব্যাঞ্চ ম্যানেজার।
মন্তব্য করুন