ডিবিডিনিউজ২৪ রিপোর্ট | কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের ভূমি অধিগ্রহন শাখায় কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। শতকরা ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশনের কোটি কোটি টাকা কমিশন আদায় করলেও যেন দেখার কেউ নেই। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, আমলা ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় সরকারের বড় বড় মেগাপ্রকল্প গুলোর অধিগ্রহনের টাকায় ভাগ বসায় সার্র্ভেয়ারের মাধ্যমে। সর্বশেষ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১৫) একটি অভিযান পরিচালনা করে ঘুষের টাকা সহ সার্ভেয়ার ওয়াসিমকে আটকের পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক সার্ভেয়ার ওয়াসিম এসব তথ্য দিয়েছে র্যাবকে। র্যাবের বিভিন্ন সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারকে বিশে^র কাছে তুলে ধরতে দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয়। দেশের বড় বড় মেগাপ্রকল্প গুলো বেশিরভাগ কক্সবাজারকে ঘিরে। বিশেষ করে বাস্তবায়ণাধীন কক্সবাজার রেললাইন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেরিন ড্রাইভ, এলএনজি ও কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিমানবন্দর সহ বিভিন্ন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহনের কাজ চলে আসছে জেলা ভূমি অধিগ্রহন শাখায়। উক্ত অফিসে বর্তমানে কর্মরত ওয়াসিম (র্যাবের হাতে আটক), ফরিদ ও ফেরদৌস (বর্তমানে পলাতক) ও সাইফুল ইসলাম সিন্ডিকেট করে কোটি টাকার বানিজ্য করে আসছে।
অভিযোগ উঠেছে, সার্ভেয়ার সাইফুল ইসলাম নানাভাবে অভিযোগ দিয়ে কৌশলে আদায় করে নেয় ৫০ শতাংশ কমিশন। তার একটি নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ফাইলের উপর অভিযোগ এনে আবেদন করিয়ে কৌশলে হাতিয়ে নেয় কোটি টাকার কমিশন। সম্প্রতি ১৬লাখ টাকার একটি ফাইলে সে একাই কমিশন আদায় করেছে ৮ লাখ টাকা। এছাড়াও র্যাবের তাড়া খেয়ে পলাতক থাকা সার্ভেয়ার ফরিদ আদালতে চলমান (অপর-২০৭/১৯) মামলায় দালাল সেলিম ও হান্নানকে দিয়ে জাল দলিল সৃজন করে মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নের নুনাছড়ি গ্রামের মৃত মোহাম্মদ হোসেনের স্ত্রী ছারা খাতুনের নামে অধিগ্রহনকৃত সম্পূর্ণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ছারা খাতুন একদিকে আদালতে চলমান মামলায় দৌড়াদোড়ি, অন্যদিকে জেলা ভূমি অধিগ্রহন শাখায় হাজিরা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ছারা খাতুন অভিযোগ করছেন, সার্ভেয়ার ফরিদের লেলিয়ে দেয়া দালাল সেলিম ও হান্নানের ভয়ে ‘এল এ’ অফিসের দ্বারে কাছেও যেতে পারছেন না।
দীর্ঘদিন ধরে জেলা ভূমি অধিগ্রহন শাখা প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমকে কাজে লাগিয়ে শুধু সার্ভেয়ার নয়, পিয়ন থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও ভাগাভাগি করে কমিশনের টাকা। বিশেষ করে রেললাইন নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের কাজ জোরেশোরে চলছে। হাজার হাজার কোটি টাকার এসব প্রকল্প ঘিরে কক্সবাজারে একটি দুর্নীতিবাজ চক্র গড়ে উঠেছে। তারা দুর্নীতি আর অনিয়মের হাট বসিয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্র। ১৫ শতাংশ ঘুষ ছাড়া জমি অধিগ্রহণের টাকা হাতে পান না ভূমির মালিকরা। ভূমি অধিগ্রহণ অফিস ঘিরে সেখানে সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে দালালদের পকেট ভারী হচ্ছে। ঘুষের ৯৩ লাখ টাকাসহ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি র্যাবের একটি অভিযানে সার্ভেয়ার ওয়াসিম খানকে কক্সবাজারের বাহারছড়া বাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পলাতক রয়েছেন মো. ফরিদ উদ্দিন ও মো. ফেরদৌস খান নামে দুই সার্ভেয়ার। এরপরই ভূমি অধিগ্রহণ ঘিরে কক্সবাজারে একটি বড় ধরনের সিন্ডিকেটের তথ্য সামনে আসে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রেপ্তার সার্ভেয়ার ওয়াসিমের কাছ থেকে একটি ডায়েরি পাওয়া গেছে। সেখানে কাকে কী পরিমাণ অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করার মধ্য দিয়ে ভূমি অধিগ্রহণের নামে কোটি কোটি টাকা ঘুষ আদায় করা হতো তার হিসাব রয়েছে। সাতটি ভাগে কক্সবাজারের প্রশাসনের দায়িত্বশীল পদে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে ওই ঘুষের টাকা বণ্টন করে দেওয়া হতো। স্থানীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে কয়েকটি ধাপে ঘুষের টাকার ভাগবাটোয়ারার তথ্য ওই ডায়েরিতে রয়েছে। কানুনগো থেকে শুরু করে অন্যান্য পদে কাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে তা লিখে পাশে বলা হয়- ‘নবম ধাপ পর্যন্ত পেইড’।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের ডিসি কামাল হোসেন একটি জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন, কক্সবাজারে ৭-৮টি প্রকল্প চলমান। ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় যাতে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি না হয় তা নিশ্চিত করতে চার এডিসিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বচ্ছ অভিযোগ বক্স বসানো হয়। চেক নেওয়ার সময় কেউ কখনও অভিযোগ করেনি যে, তাদের কাছ থেকে ঘুষ বা অনিয়ম করে টাকা নেওয়া হচ্ছে।
এতকিছুর পরও কেন দুর্নীতি রোধ করা যায়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, একেকজন সার্ভেয়ার একেক জায়গা থেকে এসেছেন। তাদের কারও কার বিচ্যুতি ঘটেছে। এই দুষ্টু চক্রে নানা শ্রেণিপেশার লোক রয়েছে। যারাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হয়েছে। গ্রেপ্তার ও পলাতক সার্ভেয়ারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তুলনামূলক স্বচ্ছ সার্ভেয়ারকে কক্সবাজারে পদায়ন করতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে একটি হেল্প ডেস্ক খোলা হবে।
কক্সবাজারের র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক আজিম আহমেদ বলেন, শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত থাকবে। যারা দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে থাকবে তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলেই অভিযান চালাবে র্যাব।
জানা গেছে, শুধু সার্ভেয়ার নন, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, কানুনগো ছাড়াও আরও ওপরের দিকে অর্থের ভাগ যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের কোন কর্মকর্তাকে কত টাকা দেওয়া হয়, তা রেজিস্ট্রার খাতায় হিসাব রাখতেন সার্ভেয়ার ওয়াসিম।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কক্সবাজারে সরকারি হিসাবে জমির দাম বেশি। তাই ভূমি অধিগ্রহণ করলে ক্ষতিগ্রস্তরা মোটা অঙ্কের টাকা পান। এই সুযোগে ভূমি অধিগ্রহণ অফিসে একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কোনো ভূমির মালিক অধিগ্রহণের টাকা হাতে পাওয়ার আগেই দালালরা তাদের কাছ থেকে খালি চেক রেখে দেয়। এরপর টাকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই চেকে টাকার অঙ্ক বসিয়ে ঘুষ আদায় করে। এরপর দালালদের হাত ধরে ওই টাকা চলে যায় সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে। কোনো ভূমির মালিক এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেলে তাদের ১৫ শতাংশ ঘুষ হিসেবে ১৫ লাখ টাকা দিতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে থাকে কমিশনের টাকা। ঘুষের ১৫ শতাংশের মধ্যে ১-২ শতাংশ নেয় দালালরা। বাকি ১৩ শতাংশ অর্থ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগ হয়। এরই মধ্যে পাঁচ-ছয় কোটি টাকা ঘুষ হিসেবে বিভিন্ন কর্মকর্তার পকেটে গেছে এমন নথি পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, র্যাবের অভিযানের পর কক্সবাজারের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার অনেকেই গা-ঢাকা দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ হঠাৎ ছুটি নিয়েছেন। গোয়েন্দা তথ্য ছিল, সার্ভেয়ার ওয়াসিমসহ একটি চক্র ১৯ ফেব্রুয়ারি আড়াই কোটি টাকা ঘুষের অর্থ লেনদেন করবে। এই খবর পাওয়ার পরপরই অভিযান শুরু করে র্যাব। অভিযানের পর এখন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে বাঁচতে অনেক সার্ভেয়ার ও কানুনগো দুর্নীতির অর্থ দালালদের কাছে তুলে দিচ্ছেন। দালালরা তাদের নামে-বেনামে হিসাব নম্বরে ওই টাকা জমা রাখছে। কোনো কোনো দালাল নিজের বাড়িতেও জমা রাখছে টাকার ব্যাগ।
ভূমি অধিগ্রহণের নামে দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনায় গোয়েন্দারা আরও বিশদভাবে খোঁজ নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন দালালও রয়েছে। তারা হলো- কালারমারছড়া ইউনিয়নের আব্দুল হান্নান, একই এলাকার আমান উল্লাহ, কালারমারছড়ার নুনাছড়ি এলাকার লিয়াকত উল্লাহ, শাপলাপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদ সেলিম, দিদার, মাতারবাড়ীর হেলাল, বাবর চৌধুরী, হোছাইন, সাগর, ধলঘাটা ইউনিয়নের তাজ উদ্দিন, মো. শফিউল আলম, পেশকারপাড়া এলাকার মো. মুবিন ওরফে উত্তরবঙ্গের মুবিন, ঈদগাহ এলাকার মো. তৈয়ব, রশিদনগর ইউনিয়নের মো. শাহজাহান, ঘোনারপাড়ার আলমগীর ও শহরের কলাতলী এলাকার সাজ্জাদ, কক্সবাজার পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা সালাহ উদ্দিন, মহেশখালীর নুরুল হুদা কাজল, পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা কুতুব উদ্দিন, শহরের নিরিবিলির ৪র্থ তলায় সিন্ডিকেট অফিস নিয়ে ফয়জুল আলম, ইনানীর আহমদ হোসেন, মোহাম্মদ শফিরবিলের মুহিব উল্লাহ, মহেশখালীর রনি, পিএমখালীর নুরুল আবছার, মহেশখালীর দিদার, শহরের বানুপ্লাজায় অফিস নিয়ে রফিক। এছাড়াও এলএ শাখার অন্যতম শীর্ষ দালাল জালাল উদ্দিন চক্র। এই চক্রে নেতৃত্ব দেন কালারমারছড়ার মৃত ফজলুল করিমের ছেলে জালাল উদ্দিন, মৃত হোছন আলীর ছেলে নুুরুল ইসলাম বাহাদুর, মৃত নুরুল হুদার ছেলে জাফর আলম, মৃত হোসেনের ছেলে মমতাজ।
কক্সবাজারে এটা অনেক দিন ধরেই প্রচলিত রয়েছে- ভূমি অধিগ্রহণ শাখার ইট-পাথরও ঘুষ খায়। সেখানে যারা ছোটখাটো পদে চাকরি করেন তারাও নিয়মিত ঢাকায় বিমানে যাতায়াত করেন। ভূমি অফিসের দালাল হতে পারলেও যে কারও জীবনে মোড় ঘুরে যায়। অনেকের ভাষ্য- ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সার্ভেয়ারের পদটি গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রতিবেদনের ওপর কে কত টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন, তা অনেকাংশ নির্ভর করে। তারা এ ক্ষমতার অপব্যবহার করতে থাকেন। এতে অল্প সময়ের মধ্যে কোটি কোটি টাকার মালিক হন তারা।
জানা গেছে, সার্ভেয়ার ওয়াসিম, ফরিদ ও ফেরদৌসের বাসায় অভিযানে বিভিন্ন ব্যাংকের ১৫ লাখ টাকার চেক, লেনদেন রেজিস্টার, হিসাব বিবরণীসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা কাগজপত্র জব্দ করা হয়। জেলা প্রশাসনের ভূমি হুকুম শাখার সার্ভেয়ার ওয়াসিমের বাসা থেকে ২৭ লাখ টাকা, একই শাখার সার্ভেয়ার ফেরদৌসের তারাবনিয়ারছড়া বাসা থেকে ২৭ লাখ টাকা ও সার্ভেয়ার ফরিদের বাসা থেকে ঘুষের ৬০ লাখ ৮০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। বিভিন্ন নথিতে সার্ভেয়ার, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের নাম এবং লেনদেন হিসাব বিবরণী রয়েছে। অর্ধশত দালালের নাম উঠে এসেছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার সার্ভেয়ার ওয়াসিম, পলাতক ফরিদ ও ফেরদৌসের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলাটি তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জানা গেছে, সার্ভেয়ার ওয়াসিমের বিরুদ্ধে এর আগে মামলা করেছিল দুদক। বছর দেড়েক আগে ঢাকা থেকে বদলি হয়ে তিনি কক্সবাজার যান। ফেরদৌসও বছর দেড়েক আগে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যান। মূলত ওই সময় কক্সবাজারে বড় বড় প্রকল্পের অর্থ ছাড় শুরু হয়। টার্গেট করে মোটা অর্থ হাতিয়ে নিতে তারা কক্সবাজারে বদলি হন।-কক্সবাজার টাইমস
মন্তব্য করুন